তুরস্কের ইস্তানবুলে শবে-বরাত পালন করার পর পরই শুরু হয়ে যায় রমজানের প্রস্তুতি। রোজার মাস বছরের এগারটি মাস পর আসে ভিন্ন আবহে, ভিন্ন একটা উৎসবের আমেজ নিয়ে। রমজান আসার সাথে সাথে তুরস্কে নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের দামে ছাড় দেওয়া শুরু হয়। মানবিকতার উজ্জীবন ঘটুক এই প্রত্যাশা এখানের দায়িত্বনিষ্ঠ সৎ ব্যবসায়ীদের কাছে। রহমত মাগফেরাত নাজাতের দিনগুলোতে নাগরিক শান্তি অটুট থাকাই উদ্দেশ্য।
ইস্তাম্বুলসহ অন্যান্য শহরের রোজাদাররা রমজানের প্রথম রাতে ‘আইয়্যুপ সুলতান’ মসজিদে সাহরি করার জন্য আসেন। তারপর তাঁরা ফাতিহ সমাধিতে ঘুরতে যান। ফাতিহ এর সমাধি দর্শন শেষ করে হিরকাই শরীফ যান। তারপরে সুলতান আহমেত, টপকাপি প্যালেস পরিদর্শন করেন। সবশেষ বসফরাস হলো সকলের জন্য আকর্ষণীয় যায়গা। সাধারণত ইফতারের আগেই সকলে বসফরাস দেখে ইফতার করতে বসেন। মাগরিবের পর ইস্তানবুলের বাহিরের রোজাদাররা তারাবীহ এর আগে মিষ্টির দোকানগুলোতে ভীড় জমান। আর এদিকে ইস্তানবুলের স্থানীয়রা ফাতিহ, সুলতান আহমেত সহ ক্যাফেগুলোতে চায়ের আড্ডায় মেতে উঠেন। তবে অনেক ক্যাফেতে গান, মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট সহ নৃত্যও পরিবেশিত হয়। এরপর আজানের সাথে সাথে সকলে মিলে এশা এবং তারাবীহ আদায় করে নেন। তারাবীহ শেষে ভিন্ন শহর থেকে আগতরা তাদের নিজ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আবার অনেকে ফাতিহ, সুলতান আহমেদ এর সামনে বসার জায়গা সহ পার্ক গুলোতে পরিবার-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বিভিন্ন আড্ডার আসর জমান। যে আড্ডার আসর চলে সেহরী পর্যন্ত। এভাবেই তুর্কিরা তাঁদের রমজানকে বরণ করে নেন।
প্রায় ৪ বছর আগে যখন আমি তুরস্কে আসি তখন আঠারো থেকে উনিশ ঘণ্টার লম্বা দিন। এর মাঝে রোজা শুরু হবে শুনে বেশ খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। সবগুলো রোজা রাখা হবে কিনা, রোজা রেখে ক্লাস করতে পারবো কিনা, তার্কিশ সেহরী ও ইফতারের খাবার মেনুতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো কিনা, ইত্যাদি। যাইহোক, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে রোজাগুলো কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারিনি। ডরমিটরিতে রাতের দুই-তৃতীয়াংশ পার করে সেহরি খাওয়ার লাইনে দাড়াতাম ডাইনিং-এ। ডাইনিং-এ অন্যান্য মাসের খাবারে মুখে জং ধরে গেলেও রোজার মাসের খাবার থাকত একটু ভিন্নতা। কোনো কোনো দিন আবার খাবার কিনে এনে সেহরি খেতাম। ইফতারি করতাম সেই ডরমিটরিতেই। তবে বিভিন্ন সংস্থাগুলোতে ইফতারির সুন্দর ব্যবস্থা থাকতো রোজার সময়। অনেক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী আছেন, যারা বিভিন্ন সংস্থায় ইফতার করে, সেই খাবার নিয়ে এসে রাতে সেহেরিও করে নেন। শুধু যে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরাই ইফতারীতে যোগদান করে, তা নয়। অন্য ধর্মের ছাত্র-ছাত্রীরাও যোগদান করে। এতে কেউ কাউকে অনুৎসাহিত করে না। বরং তাদেরকে উৎসাহিত করে এবং আশেপাশে যদি আরো কেউ আসতে চায় তাকে যেন সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সাধুবাদ জানায় সবাই। সকলের একসাথে ইফতারীতে উৎসবমুখর হয় রোজার দিনগুলো। মাসজুড়ে পুণ্যের হাতছানিতে সিক্ত হয় সকলে।
সেইসাথে মনের কোণে ভেসে ওঠে দেশে থাকাকালীন রোজার সেসব দিনগুলোর কথা। আমি তখন মাত্র বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এখানে ইফতারি করার সময় আমাদের দেশীয় ইফতারির অভাব বোধ করতাম খুব। ঢাকার সেই রকমারি ইফতারি, ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, আলুর চপ আর জিলাপি। বাংলাদেশে থাকতে উৎসবের সেই আমেজটা বাতাসে ভেসে বেড়াত দিনরাত। কি সুন্দরই না কাটতো সেই ফেলে আসা দিনগুলো। বাসায় চলতো সেহরির মূল আকর্ষণ, আম দিয়ে দুধভাত খাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি। খুব স্মরণ করি ফেলে আসা সেই দিনগুলো। তবে ইস্তানবুলে এমনই সব বাংলাদেশি পরিবার আছেন যারা খুব অল্প সময়ে আমাদেরকে খুব আপন করে নিয়েছেন। প্রতিবার তাদের বাসায় যখনই যাই তখন এক টুকরো বাংলাদেশকে ফিরে পাই। ডরমিটরিতে ফিরে গিয়েই ফোনে আম্মুর সাথে শেয়ার করি কি খেলাম, কি কি করলাম, কি হল, কিভাবে দিন গেল আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একটি ব্যাপার খুব লক্ষণীয়, আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রোজার মাসকে সহজ করে দেওয়া হয় কাজের সময়কে পরিবর্তন করার মাধ্যমে। বিদেশে আলাদাভাবে রোজার মাসের কোনো বিচিত্রতা নেই। ছকে বাঁধা সময়, সময় এবং রোজা সঙ্গ মানিয়ে চলে, জীবনকে ধীর গতি করে না, বরং জীবনকে করে আরো প্রাণবন্ত।
মানুষের জীবনটা খুবই বিচিত্র। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে, নানা সমস্যা নিয়ে অভিযোগ নেই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ এই মানুষটিই যখন জীবন-জীবিকা বা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে প্রবাস জীবন বেছে নেয়, তখনই বুঝতে পারে দেশ আসলে কতটা আপন তাদের কাছে। এদেশে শিশুসহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মসজিদে যায়। সাধারণত নিচতলা পুরুষদের জন্য আর উপর তলা নারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এইযে সবাই মিলেমিশে, দল বেঁধে ইফতার করতে যাওয়া, বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশা সেটাও কি কম আনন্দের? আমাদের দেশের রোজার উৎসবেও কি কিছুর কমতি আছে? বাংলা মায়ের প্রতিটি সন্তানই যেন থাকে দুধে ভাতে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। উৎসব সব দেশেই আছে। তবে তা ভিন্ন দেশে ভিন্ন বেশে।
দিন যায়, সময় বয়ে চলে, বছর আসে, রমজান মাস আসে, আবার তা দেখতে দেখতে চলেও যায়। রোজার মাসে সংযমের পরিচয় দিয়ে অতি ভোজনে নিজেকে ডুবিয়ে না রেখে আত্মশুদ্ধির শিক্ষায় সকলেই উজ্জীবিত হবেন এই প্রত্যাশায়।
রায়হানা হানী,
ইস্তানবুল ইউনিভার্সিটি।