কতদিন কত সপ্তাহ হয়ে গেল, কত সপ্তাহ কত মাস হয়ে গেল, কত মাস কত বছর হয়ে গেল। সবি যেন খুবই দ্রুত চলে যায়। বাবা, কি দিয়ে শুরু করব, ভাবছি আর ভাবছি। অনেক কথা জমা আছে, এত কথা কি শেষ হবে আজ! এতটা পথ পেরিয়ে এসেছি কিন্তু কখনো স্মৃতিগুলো ভুলিনি একদমই স্পষ্ট। আর প্রতিনিয়ত মিস করছি তোমায়। মাঝে মাঝে নিজেকে একজন সাহসী ও বিপ্লবী মানুষের সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে ভালো লাগে। যাক শুরু করা যাক জীবন থেকে, আমরা চারভাই এক বোনের পরিবার। ছোটকাল থেকে আল্লাহর কৃপায় আমি একটু পড়ালেখায় মনোযোগী ছিলাম বিধায় বাবা আমাকে খুবই নজরে রাখতেন। ফলাফল স্বরূপ প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে খুবই কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করতে পেরেছিলাম। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত আমার সেরা উপহার ছিল বাবা, যিনি আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক।
আমাদের একটা মেডিসিন দোকান ছিল। বাবা সেথায় নিয়মিত বসতেন। স্কুল আর বাজার পাশাপাশি ছিল। সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় একসাথেই বের হতাম। গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে নানান গল্প উপদেশ নিয়ে যথাসময়ে স্কুলে পৌছতাম। তিনি একটা উপদেশ প্রায় দিতেন। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝিছ না। জীবনের পরম্পরাই বাবার ঐ উপদেশের মূল্য ঠিকই বুঝতেছি। প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে শ্রেণিতে প্রতিবারেই প্রথম হওয়াতে বাবা খুবই খুশি হতেন আর বলতেন তোকে আমি উচ্চশিক্ষায় পড়াবো। তার এই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত। কিন্তু তিনি তো নেই এই ধরায়। হারিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। আমি প্রায় স্বপ্ন দেখি বাবা তুমি এসেছো আবার ফিরে, স্বপ্ন শেষে খুঁজি তোমায়, কোথায় হারিয়ে গেলে। পিতা নেই তাই মম ভালবাসার রাজ্যে আজ কিছুটা দৈন্যতা। পিতা সতত ভালবাসত মোরে, পূর্ণ করত মনের আশা।
আমি ছোটকাল থেকে ক্রিকেট খেলা খুবই পছন্দ করতাম আর খেলতাম। মনে পড়ে বয়স যখন আট, ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পাকিস্তান বনাম অষ্টেলিয়ার মধ্যকার ফাইনাল খেলা দেখার জন্য বাবার সাথে জেদ করি। পরিশেষে বাবা ঠিকই সন্ধার পর হওয়া সত্ত্বেও আমায় তার বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলেন। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেইদিন পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় দেখতে হয়েছিলো। আমি বলব না যে আমি কখনো কাউকে দেখা পাইনি আমার পিতা সমান, আর আমি অন্য কোন মানুষের চেয়ে বেশি ভালবাসি না। দেখতে দেখতে সময়ের বিবর্তনে ১৫ টি স্মৃতির বছর কেটে যাচ্ছে, জীবনেতিবৃত্তের অবুঝ সময়ে তোমাকে হারানো টা আমাদেরকে এখনো কাদায়,মনের স্মৃতির জানালা খুলে, বাবা তোমায় মনে পড়ে।
গ্রাম্য জীবনে আমাদের এলাকায় সাপ্তাহিক শনিবার ও মঈলবার বাজার বসত। বাবার সাথে সাপ্তাহিক বাজারগুলো থেকে রকমারি জিনিসপত্র খরিদ করাটা ছিল খুবই আনন্দের। এখন তুরস্কের সাপ্তাহিক বাজার গুলোতে গেলে স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে। এক জনমে পুষে রাখা স্মৃতিপট আমাকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দেয়। সাদা পাকা চুল দাড়িতে ভালই মানাত বাবা তোমায়। মাঝে মাঝে তোমার কথা মনে আসলে অজস্র সব স্মৃতি মাথায় ঝেকে বসে। কয়েক মিনিটের জন্য আমি নিজেকে কোথাও যেনো হারিয়ে ফেলি আর অজান্তেই পানি চলে আসে চোখে।
ছোটকাল থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায় ভালো মনোযোগিতা ছিলো। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার সাথেতো শ্রেণীতে প্রথম এবং প্রতিষ্টানের সর্বোচ্চ নাম্বারের পুরস্কার গুলো আমারি থাকত। আমার এই সব সাফল্যে বাবা খুবই খুশি হতেন এবং গর্ব করতেন। বাবা আজ আমি তোমাকে ভাল কিছু শোনাতে চাই। আমি ভালো আছি, বেশ ভালো, এখনি পর্যন্ত মহামারি করোনাভাইরাস আমায় ধরতে পারেনি। প্রতিটি ভালো ও সুখে থাকার মাঝে তোমাকে খুঁজি। ভাবি তুমি থাকলে আজকে অনেকটা খুশি হতে আমার সুখে থাকা দেখে।
প্রতিদিন প্রায় ঘর হতে বের হবার সময় তুমি বলতে সাবধানে চলিস বাবা! আমি হেসে বলতাম, তোমার দোয়া সাথে আছে তো! তোমাকে দেয়া কথাগুলো এখনও ভুলিনি বাবা! তোমার শেখানো পথে আজও হেঁটে চলেছি। বাবা, তুমি ভেবো না আমি তোমায় ভুলতে বসেছি বিধায় স্মৃতিগুলো স্মরণার্থে দু কলম লিখছি। তুমি যে আমার এই বৃহৎ জীবনে একমাত্র অপ্রাপ্তি, তোমায় ভুলি কি করে? শত ব্যস্ততার মাঝেও তুমি আমার ঠিকই মনে পর পার্থক্য শুধু বহিঃপ্রকাশের !!! তুমি যাবার পর আমার এমন কোনো সুখের স্মৃতি নেই যেখানে আমি তোমাকে মনে করি নি !! এমন কোনো প্রাপ্তি নেই যেখানে তোমার স্মৃতিচারণ অবহেলিত ছিল !!
খুব মনে পড়ে বাবা থাকাকালীন প্রতিটি ঈদ যেনো অন্যরকম কাটতো, ঈদের চাঁদ মামা দেখার আগেই নতুন জামাকাপড়ের খরিদ করার আনন্দ যেনো বহিঃপ্রকাশ করা যেতো না। একসাথে ঈদের নামায পড়তাম। ঈদের দিনগুলোতে আমাদের বাড়ি খুবই জমজমাট থাকত। ঈদের সকালবেলার নাস্তার পরে সবাই মিলে ক্রিকেট খেলতাম। এটা ছিলো মহা আনন্দঘন পরিবেশে যেখানে মাঝে মাঝে বাবা চাচারা অংশ নিতেন। কুরবানির ঈদের গরু জবাই থেকে শুরু করা শেষ করা পর্যন্ত অজস্র স্মৃতি রয়েছে।
আমি দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় অংক এবং ইংরেজীতে দুর্বল ছিলাম। আমাকে প্রতিষ্ঠানের বাহিরের দুজন শিক্ষকের নিকট অংক ইংরেজী পড়িয়ে অনেক শক্তিশালী করেছিলেন। ফলাফল স্বরূপ আমিই প্রথম প্রতিষ্ঠান থেকে জিপিএ ফাইব পেয়েছিলাম। আমাকে তিনি তার স্বপ্নের মতো করো বড় করতে চেয়েছিলেন। বাবা, এখন আমার সাফল্যে তোমাকে খুব মনে পড়ে, তুমি ছিলে আমার সকল প্রেরণার উৎস। এখনো মাঝে মাঝে আমার স্বপ্নভঙ্গের দিনগুলোতে তোমায় মিস করি, তুমি থাকলে আমায় অনেক শক্তি সাহস যোগাতে। কতদিন কতরাত দেখিনা তোমায়, আর ডাকতে পারিনি একটি দায়িত্বশীল শব্দ “বাবা”। আর বলতে পারিনি বাবা “আমি তোমাকে ভালোবাসি” অনেক বেশী ভালোবাসি।
সময় তখন ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাস, বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্রমাগত অসুস্থতা বাড়তে থাকায় আমরা উনাকে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাই। প্রাথমিকভাবে কোন রোগ নির্ণয় করতে না পারায় বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। কয়েক মাস অতিবাতিত হওয়ার পরে পুনরায় অবস্হার অবনতি হওয়া্রা পুনরায় ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তখনি বাবার লিভার সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তার বললেন আপনারা অনেক দেরী করে ফেলেছেন, আমাদের কিছু করার নাই। অবশেষে বাড়িতে নিয়ে আসি। মে আর জুন মন খারাপের, দীর্ঘশ্বাস আর প্রবল আক্ষেপের মাস !!! তাই এ সময়টায় নীরব থাকি, বলা যেতে পারে কিছুটা জোর করে ভূলে থাকা জীবনের ঘটে যাওয়া সব থেকে খারাপ আর অসহায় মুহূর্তগুলো !!! বাবার অসুস্থ হওয়া, বাবাকে হারানো এই মাস গুলোকে ঘিরে, কত যে ভয়াল স্মৃতি, বুকের ভিতরটা কেপেঁ উঠে।
জীবন মনে হয় কিছু না শুধু মৃত্যুর দিকে পথযাএী, মৃত্যুর মত এত স্নিগ্ধ, এত গভীর, এত সুন্দর আর কিছুই নাই। কারণ মৃত্যু অনিবার্য। যেটা অনিবার্য তাকে ভালোবাসাই শ্রেয়। মাঝে মাঝে মন খারাফ হয় কষ্ট পায় যখন দেখি একটা মানুষ তার সময়ের আগেই চলে যায়। জীবনের কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষ নিজেই করে, আর কিছু পরিবর্তন মানুষের জীবনে আসে তা কখনো সে চায় নি কিংবা আশা করে নি। তেমনি একটি দিন ২০০৫ সালের সাতই জুন রোজ মঈলবার, সকাল থেকেই বাবার ব্যাথা বাড়তে থাকে। আমিতো নির্বাক, বুঝতে পারছিলাম না বাবা বেশিক্ষন থাকবেন না আমাদের সাথে। আমার এখনো মনে পড়ে তুমি চলে যাবার দিন মায়ের সেই অসহায় কান্নাজড়িত চাহনি, একদিকে তোমার চলে যাবার সীমাহীন কষ্ট, অন্যদিকে তোমার চোট ছেলেমেয়েদের শিশুসুলভ চাহনি, তোমাকে হারানোর কষ্ট বুঝতে না পারার অব্যক্ত বেদনা। হঠাতই মা চিৎকার করে বলেছিলো, তোর আব্বু না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কি তার সান্ত্বনা, কিউবা হবে তার পিতৃহারা সন্তানদের সান্ত্বনা। দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য মায়ের কান্না আজো চোখের জ্বলে ভাসায়। আর উপলব্ধি করি, কত গভীর সেই বাবা হারানোর অনুভূতি।
জীবনের প্রায় আটাশ টি বছর পার করে ফেললাম। কতটা সময় পেরোলে তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা লাঘব হবে বলতে কি পারো বাবা? বুকের গভীরে কোথাও একটা স্মৃতিসৌধ আছে যার মুখোমুখি দাঁড়ালেই তোমাকে মনে পড়ে, দেখতে পাই সেই বটবৃক্ষকে যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, অনুভবে স্পর্শ করতে পারি তার অস্তিত্ব। তোমার ইচ্ছে পূরণে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙ্গে মানুষ হওয়ার চেষ্টায় রত আমি বাবা। তুমি বেঁচে থাকতে কিছুই করতে পারেনি। তাই তোমার জন্য এই জীবনে সবচেয়ে পঠিত দোয়া করে যাবো “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা”. যাতে আল্লাহ্ তোমার গুনাহগুলো মাফ করে দেন, আমিন। বাবাকে নিয়ে স্বরচিত ছোট কবিতাটি শেয়ার করতে চাই,
সবার মাঝে বাবা আমার ছিল বড়ই আপনজন, জীবন প্রভাতে হারিয়ে গেলো শূন্য করে মন।
বাবা আমার আসবেনা ফিরে এই জগতে আর, তাইতো মোরা করি দোয়া সদা চেষ্টা বার।
বাবা ছিল আমাদেরী কাছে খুব কাছেরী মানুষ, জীবন প্রভাতে ধরে দিত নানা ভূলের হুশ।
সবার মাঝে ছিল বাবা আমার খুব আবেগী চঞ্চল, জীবন পরিচালনায় ছিল বাবা একমাত্র সম্বল।
হারিয়ে গেলো আমার বাবার ফজরের ডাকাডাকি, কেনো যে আমরা শুধু যে দেই নামাযেই ফাকি।
বাবার জন্য করবো দোয়া প্রতি বেলাতে, আল্লাহ যেনো নসিব করে শান্তিময় জান্নাতে।
পরিশেষে সকল বাবাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। বেঁচে থাকুক হাজার বছর বাবাদের স্বপ্নগুলো, আল্লাহ কুরআনে বর্ণিত বাণীটুকু যেনো আমরা ভুলে না যাই।
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।” [১৭-২৩]
সাইয়্যেদ মাগফুর আহমদ