তুরস্কের ইস্তাম্বুল এমন একটি শহর যা দাঁড়িয়ে আছে এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশের মাঝখানে। আর বসফরাস প্রণালী ইস্তাম্বুলকে দুটি মহাদেশ ভাগ করে রেখেছে । এই শহরেরই ইউরোপীয় অংশে বসফরাস প্রণালীর গাঁ ঘেঁষে রয়েছে বাইজেন্টাইন শাসনামলে বানানো দৈত্যাকৃতির এক স্থাপত্যবিস্ময় ‘আয়া সোফিয়া’। এই স্থাপত্যবিস্ময় স্থাপত্যকলার ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে, সে ইতিহাসে যোগ করেছে এক অন্য মাত্রা।
আনুমানিক ১৫০০ বছর আগে এটি বানানো হয়েছিল বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। কালের বিবর্তনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক সনাতন খ্রিস্টানদের ক্যাথেড্রাল, রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথেড্রাল এবং মুসলিমদের মসজিদ হিসেবে। তবে, বর্তমানে এটি সব ধর্মের মানুষদের জন্য জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত রয়েছে। এ স্থাপনাটিতে খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা অনুসঙ্গের সহাবস্থান চোখে পড়ে। এ দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধ্যান-ধ্যারণা আর চিন্তা-ভাবনা এসে যেন এক হয়ে মিলে গেছে আয়া সোফিয়াতে।
আয়া সোফিয়ার পরিচিতি
আয়া সোফিয়া (তার্কিস উচ্চারণ, Ayasofya-আয়া সোফিয়া) একে ‘পবিত্র জ্ঞানের চার্চ’ বা ‘স্বর্গীয় জ্ঞানের চার্চ’ নামেও ডাকা হয়। বাংলাতে এটিকে হাজিয়া সোফিয়া বা হাগিয়া/হ্যাগীয়া সোফিয়াও বলা হয়। এটি যখন প্রথম নির্মিত হয়েছিল, তখন থেকে ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগ পর্যন্ত হাজিয়া সোফিয়া (হলি উইজডম) নামে পরিচিত ছিল এবং এটি মেগালে এক্কলেসিয়া (গ্রেট চার্চ) নামে পরিচিত ছিল। তৈরি করা হয়েছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। যদিও সময়ে-সময়ে ক্ষমতার পালাবদলে মুসলিমরা মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাই বহু সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের নীরব সাক্ষী এটি।
আয়া সোফিয়ার নির্মাণ ইতিহাস
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, আয়া সোফিয়ার আজ অবধি একই জায়গায় ৩ বার নির্মিত হয়েছিল।
সর্বপ্রথম ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটান্টিয়াস, বাইজেন্টাইন গির্জা হিসেবে আয়া সোফিয়া নির্মাণের নির্দেশ দেন। একেবারে শুরুর দিকে আয়া সোফিয়ার ছাদ ছিল কাঠের তৈরি। বাইজানটাইন সম্রাট আর্কেডিওসের সময় পারিবারিক কলহের জেরে শহর উত্তাল হয়ে উঠে এবং যার বলি হয় আয়া সোফিয়া। রাজপরিবারের রাজনৈতিক কলহের জেরে আনুমানিক ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে সে ছাদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল।
এরপর ৪১৫ সালে আয়া সোফিয়া নতুন করে নির্মাণ করেন সম্রাট থিওডোসিওস। এই দ্বিতীয় আয়া সোফিয়ার পাঁচটি প্রধান অংশ ছিল, ছিল একটা বিরাটাকৃতির প্রবেশপথ এবং প্রথমটির মতো এর ছাদও ছিল কাঠের তৈরি। এক শতাব্দীর কিছু বেশি সময় টিকে ছিল দ্বিতীয়বারে নির্মিত আয়া সোফিয়া। দ্বিতীয়টিরও কপালে জুটেছিল আগুনের আঁচ। সেবারে আয়া সোফিয়া পুড়েছিল সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহের আগুনে। শহরজুড়ে আবার বড় ধরণের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ৫২৭-৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকাজ পরিচালনা করেন। আগুন লাগার ফলে মূল কাঠামোটি ভেঙে পড়ে এবং অন্যান্য অংশও ভিত্তি হারিয়ে নড়বড়ে হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার পুড়ে ছাই হওয়া আয়া সোফিয়াও মেরামতের অযোগ্য ছিল।
তাই সম্রাট জাস্টিনিয়ান ৫৩২ সালে নতুনভাবে এ গির্জা নির্মাণের আদেশ দেন। যেটি আগে কখনো নির্মাণ হয়নি, এমনকি ভবিষ্যতেও হবে না৷ সেসময়ের বাইজেন্টাইন ইঞ্জিনিয়ার মিলিটাস ইসিডোর এবং গণিতবিদ ট্রেলস অ্যান্থেমিয়াস গির্জাটি নির্মাণের জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন। আয়া সোফিয়ার নিমার্ণে জাস্টিনিয়ান প্রায় ১৫০ টন স্বর্ণ বিনিয়োগ করেছিলেন৷ নির্মাণে ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেছেন। গির্জার নির্মাণ কাজটি ৫ বছর ১০ মাসের মধ্যে শেষ হয়েছিল এবং এই তৃতীয়বার নির্মিত অনন্য সাধারণ আয়া সোফিয়ার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে সম্রাট জাস্টিনিয়ান এই পবিত্র স্থাপনাটি পুনর্নির্মাণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান হিসেবে উপস্থাপন করেন।
গির্জার ভিতরে মোজাইকগুলি সম্পন্ন করার সময়টি ছিল ৫৬৫-৫৭৮ এর মধ্যে। বাইজেন্টাইন ইতিহাসিকরা লিখেছিলেন যে এটি ছিল তখন কার সময়ের বিশ্বের বৃহত্তম বিল্ডিং। যা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বগৌরবে।
আয়া সোফিয়ার কারুকার্য
যখন থেকে আয়া সোফিয়ার তৃতীয় এবং শেষ সংস্করণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়, তখন থেকে আজ অবধি এই স্থাপত্যশৈলী জনমনে বিস্ময়ের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। আয়া সোফিয়াতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই দর্শনার্থীরা এর বিশালতা আর নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। আয়া সোফিয়ার প্রধান কক্ষটি এতটাই বিশাল যে, ইউরোপের বড় বড় ক্যাথেড্রালগুলোকেও এর কাছে বামন মনে হয়। বাইজেন্টাইন ফ্লোর পরিকল্পনার নকশাই এমন যে, তা দর্শনার্থীদের চোখে একধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে।
আয়া সোফিয়ার ছাদের বিশাল সোনালী গম্বুজটি মেঝে থেকে কমপক্ষে ১৫০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। সামনে থেকে দেখতে সেটি আরও অনেক বেশি উঁচু মনে হয়। সোনালী রঙের কারণে ছাদের এই বিশাল গম্বুজটিকে প্রায়শই ‘স্বর্ণের গম্বুজ’ বলা হয়ে থাকে। এই গম্বুজের কেন্দ্রবিন্দু থেকে চল্লিশটি রিব চতুর্দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, যেন সূর্য রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের চারিদিকে। গম্বুজ থেকে ছড়িয়ে পড়া চল্লিশটি রিব শেষ হয়েছে চল্লিশটি খিলানযুক্ত জানালাতে গিয়ে। দিনের বেলায় এসব জানালা দিয়ে আলো প্রবেশ করলে ভেতরে থাকা কাচ আর স্বর্ণের টাইলগুলো এমন একটি দ্যুতি ছড়ায় যাতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় দর্শনার্থীরা। এই দ্যুতি আয়া সোফিয়ার ‘আধ্যাত্মিক আলো’ বলে পরিচিত। এছাড়াও গম্বুজের ছাদ থেকে তারের সাহায্যে আয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরে ঝুলে আছে চোখ ধাঁধানো কতকগুলো ঝাড়বাতি। সেগুলোর আলোয় ঝলমল করে উঠে এই স্থাপত্যের ভেতরটা।
সম্রাট জাস্টিনিওনস আয়া সোফিয়াকে আরও দুর্দান্ত এবং শোভনীয় করার জন্য সমস্ত প্রদেশে সংবাদ প্রেরণের মাধ্যমে আয়া সোফিয়ায় ব্যবহার করার জন্য সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্য টুকরো সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছেন। এই কাঠামোতে ব্যবহৃত কলাম এবং মার্বেলগুলি; এটি আনাতোলিয়া এবং সিরিয়ার প্রাচীন শহর ধ্বংসাবশেষ যেমন এস্পেন্ডোস, এফিসোস, বালকব্যাক, তারসাস থেকে আনা হয়েছিল। ভবনের সাদা মার্বেলগুলি মারমারা দ্বীপ থেকে, এরিবোজ দ্বীপ থেকে সবুজ রঙের বারফি, আফিয়ন থেকে গোলাপী মার্বেল এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে হলুদ মার্বেল আনা হয়েছিল এবং আয়া সোফিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছিল। ভবনের অভ্যন্তরের প্রাচীরের আচ্ছাদনগুলিতে; একক ব্লকে এবং পাশাপাশি পাশাপাশি দুটি মার্বেলকে দুটি ব্লকে বিভক্ত করার মাধ্যমে প্রতিসম আকার প্রকাশিত হয় এবং অভ্যন্তরটিতে রঙ্গিন বর্ণের মার্বেল ব্যবহার করে একটি আলংকারিক সমৃদ্ধতা তৈরি হয়। এ ছাড়া এটি আরও জানা যায় যে ইফিসের আর্টেমিস মন্দির থেকে আনা কলামগুলি নৈবেদ্যগুলিতে ব্যবহৃত হত এবং মিশর থেকে আনা ৮ টি বারফেরি কলামগুলি অর্ধগম্বুজগুলির নীচে ব্যবহৃত হত। ভবনে ১০৪ কলাম রয়েছে, এর মধ্যে ৪০ টি নীচের গ্যালারী এবং ৬৪ টি উপরের গ্যালারীটিতে রয়েছে।
আয়া সোফিয়ার মার্বেল ডাকা দেয়াল বাদে সমস্ত পৃষ্ঠতল সুন্দর মোজাইক দ্বারা সজ্জিত। মোজাইক তৈরি করতে সোনা, রূপা, কাঁচ, পোড়ামাটির রঙিন পাথর ব্যবহার করা হত। বিল্ডিংয়ের ভেষজ এবং জ্যামিতিক মোজাইকগুলি ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে চিহ্নিত হয়েছে।
গ্রিক অর্থোডক্স ছিল বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম। যেহেতু আয়া সোফিয়া পূর্ব রোমান আমলে ইম্পেরিয়াল চার্চ ছিল, তাই এটি সেই জায়গা যেখানে সম্রাটের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত, শপথ নিতেন, মুকুট পরতেন। আয়া সোফিয়ার বর্গাকার মার্বেলের মেঝের যে অংশে রঙিন প্যাঁচানো নকশাঁ রয়েছে, গির্জার সেই মূল অংশে দাঁড়িয়েই মাথায় মুকুট পরতেন নতুন সম্রাটরা। এই রীতি প্রায় ৯০০ বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় পালন করা হতে থাকে।
নির্মাণের পর থেকে আয়া সোফিয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ অন্তত এক হাজার বছর ধরে বসফরাস ব্যাসিলিকাই ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় চার্চ৷
এই যে বিশাল আকৃতিতে আয়া সোফিয়া নির্মাণের পেছনে দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে
প্রথম উদ্দেশ্য, সৃষ্টিকর্তার কাছে মানুষের প্রার্থনার বিশালতা তুলে ধরা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, প্রার্থনাকারীদের বিস্ময়াভিভূত করা, যাতে তারা এখানে ঢোকার পরে নিজের ক্ষুদ্রতাকে উপলব্ধি করতে পারে। সমস্ত অহংবোধ জলাঞ্জলী দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।
ইচ্ছা বা আকাঙক্ষার পিলার, যাতে একটি ছিদ্র রয়েছে (Wish Column/Pillar)
বিল্ডিংয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকটিতে খোদাই করা একটি পিলার রয়েছে, কিছু উৎসে বলা হয়েছে যে এই পিলারটি সময়ের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে পবিত্রতা অর্জন করেছে। কথিত রয়েছে যে এটি পূর্ব রোমান যুগে লোকদের পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছিল; জনশ্রুতি অনুসারে, সম্রাট আইস্টিনিওস, যিনি একটি গুরুতর মাথাব্যথা নিয়ে ভবনের মধ্য দিয়ে হেঁটেছিলেন, তিনি এই পিলারটিতে মাথা ঝুঁকিয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে কিছুক্ষণ পর তার মাথা ব্যথা কেটে গেছে। জনগণের মধ্যে এই ঘটনাটি শুনে, বলা হয়েছিল যে পিলারটিতে নিরাময়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সুতরাং, লোকেদের বিশ্বাস ছিল যে তারা যখন পিলারের এই গহ্বরে আঙ্গুলগুলি রাখবেন, তাদের ভেজা আঙ্গুলগুলি সেই জায়গাটির উপরে ঘষবেন এবং তারা যে রোগটি বা কষ্টটি অনুভব করেন, তখন তা নিরাময় হয়। অন্য একটি কিংবদন্তীতে, এই আর্দ্রতাটি মেরির অশ্রু বলে মনে হয়।
অটোমান সময়কালে, যখন হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, তখন ফাতিহ সুলতান মেহমেত এবং তাঁর মাহিয়েতি তাঁর শিক্ষক আকসেমসেদ্দিনের নির্দেশে প্রথম জুমার নামাজ পড়তে আসেন, তবে তারা ভবনটির দিক কাবার মুখোমুখি না হওয়ায় তারা প্রার্থনা শুরু করতে পারেনি। কথিত আছে যে এই মুহুর্তে, হযরত খিজির (আ.) এসে এই পিলারটি থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে ভবনের দিকটি কাবার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যখন জনগন থেকে একজন তাকে দেখে ফেলে, তখন তিনি মসজিদের দিক না ঘুরিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আজ লোকেরা পিলারের ছিদ্রে তাদের থাম্বগুলি (হাতের বুড়ো আঙ্গুলি) ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের ইচ্ছা বা আকাঙক্ষা পোষন করে থাকেন।
মার্বেলের দরজা
দক্ষিণ গ্যালারী, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক কর্মকর্তারা তাদের ধর্মীয় সভা করেছিলেন, একটি মার্বেলের দরজা দিয়ে পশ্চিম গ্যালারী থেকে আলাদা করা হয়েছিল। পশ্চিমা গ্যালারী থেকে দেখলে দরজাটি দুটি পৃথক দরজার মতো লাগে, এর পৃষ্ঠে প্যানেলের ভিতরে উদ্ভিদ, ফল এবং মাছের নকশাগুলি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে মার্বেল দরজার এক পাশ স্বর্গকে উপস্থাপন করে এবং অন্য দিকটি নরকের প্রতিনিধিত্ব করে। দরজা প্রবেশের পরে সেই জায়গাটি স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সদস্যরা ধর্মীয় সভাগুলির জন্য ব্যবহার করতেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং রাজ্যের ধর্মীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, যেহেতু আয়া সোফিয়া ছিলেন ইম্পেরিয়াল গির্জা। জানা যায় যে ১১৬৬-এ, সম্রাট ম্যানুয়েল কমেনিওস পিরিয়ডের সময় সিনোড অ্যাসেম্বলি এখানে সমবেত হয়েছিল। সভার ফলাফল হিসাবে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি মার্বেল প্লেটে লেখা হয়েছিল এবং বাইরের উত্তরভাগের দেয়ালে ঝুলানো হয়েছিল। আজ বাইরের নর্থহেক্সের এই প্যানেলগুলি হল মূল অনুলিপি।
মার্বেলর কিউবস
বিল্ডিংয়ের পাশের ন্যাভসে দুটি মনোলিথিক মার্বেলের তৈরি কিউবগুলি হেলেনিস্টিক পিরিয়ডের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০-৩০) অন্তর্গত এবং প্রাচীন শহর বার্গামা থেকে আনা হয়েছিল। সুলতান তৃতীয় মুরাদের আমলে আয়া সোফিয়ায় আনা হয়েছিল এবং এই কিউবগুলি তে গড়ে ১২৫০ লিটার তরল গ্রহণ করতে পারে, মসজিদে, ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রার্থনায় শরবত বিতরণ করা হয়েছিল। অন্যান্য দিনগুলিতে জলযুক্ত কিউবসের নীচে ট্যাপ দেয়া থাকে।
গির্জা থেকে মসজিদে রুপান্তর
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে স্থাপিত এ আয়া সোফিয়া স্থাপনাটি অর্থোডক্স গির্জার জন্য সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়। এ স্থাপনাটি ১২০৪ সাল পর্যন্ত গির্জা হিসেবে উপাসনা চলে। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সংগঠিত ক্রুসেডে আয়া সোফিয়া কিছু সময়ের জন্য রোমানদের দখলে চলে যায়। সেসময় এটি রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিছুকাল অথাৎ ১২০৪ সালের পর এটি ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত হয়। যা প্রায় ৫৭ বছর ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহারের পর ১২৬১ সালে তা আবার অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয়। যতদিনে বাইজেন্টাইনরা পুনরায় এই স্থাপত্যের দখল ফিরে পায়, ততদিনে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাই বাইজেন্টাইন শাসকগণ আবারও মেরামত করে তাদের সাধের প্রার্থনালয়ের পুরনো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনেন। আর তা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯২ বছর স্থায়ী হয়। ৯১৬ বছর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আয়া সোফিয়া।
পঞ্চদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ১৪৫৩ সালের ২৯ মে এ অঞ্চল উসমানিয় খলিফা তথা অটোম্যান সম্রাট দ্বিতীয় মোহাম্মদ (ফাতিহ্ সুলতান মেহমেদ) কন্সট্যান্টিনোপল জয় করেন। অটোমানরা কন্সট্যান্টিনোপলের নতুন নাম দেয় ইস্তাম্বুল। আয়া সোফিয়াতে আহত বাইজেন্টাইন সৈন্য, মহিলা ও শিশুদের আশ্রয়স্থল ছিল। বাইজেন্টাইন পতনের পরে কিছুদিন ধরে অর্থোডক্স চার্চের সদস্যরা আয়া সোফিয়ায় পূজা অব্যাহত রেখেছিলেন।
১৪৫৩ সালের ১ জুন ফাতেহ সুলতান মেহমেত ইস্তাম্বুলে প্রথম জুম্মার নামাজ আদায় করেন, ঘোষণা করেন যে আয়া সোফিয়া অটোমান শাসনের অধীনে মসজিদ হিসাবে কাজ করবে। এরপর ক্রস, ঘণ্টা এবং চিত্রকর্মের পরিবর্তন করা হয়৷ মোজাইকগুলি আবৃত করা হয়।
প্রথম মিনারটি ১৪৮১ সালে নির্মিত হয়েছিল। ফাতেহ সুলতান মেহমেটের পরে সিংহাসন পেরিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় সুলতান বায়েজিদের রাজত্বকালে আরেকটি মিনার তৈরি করা হয়েছিল। ১৫০৯ সালে মহান ইস্তাম্বুলের ভূমিকম্পে নির্মিত প্রথম মিনারটি ধ্বংস করা হয়েছিল এবং তার পরিবর্তে একটি ইটের মিনার তৈরি করা হয়েছিল। দ্বিতীয় সুলতান সেলিমের রাজত্বকালে মিনার সিনান পুনর্নির্মাণের সময় আরও দুটি মিনার তৈরি করেছিলেন। এই কারণে, আয়া সোফিয়ার বিভিন্ন সময়ে নির্মিত ৪ টি মিনার একে অপরের থেকে পৃথক। এইগুলো আজান দেওয়া এবং ভূমিকম্পের হাত থেকে আয়া সোফিয়াকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়।
আয়া সোফিয়ার দেয়ালে এবং মেঝেতে যেসব খ্রিস্টীয় প্রতীক ছিলো, সেগুলোকে অটোমানরা ঢেকে ফেলে ইসলামিক লিপি দিয়ে। কাবার দিকে নির্দিষ্ট করে মসজিদের ঐতিহ্য অনুসারে একটি মিহরাব স্থাপন করা হয় আয়া সোফিয়ার পশ্চিমের দেয়ালে। যেটা সিজদাহ’র দিক নির্দেশ করে। সুলতান সুলেইমান পরবর্তীতে মিহরাবের দুই পাশে দু’টি ব্রোঞ্জের বাতি বসান, এবং সুলতান তৃতীয় মুরাদ বারগামা থেকে আনা মার্বেল কিউব বসান এখানে।
১৬ এবং ১৭ তম শতাব্দীতে মার্বেলেরে তৈরী মিহরাব, মিম্বার আয়া সোফিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিল। মিহরাবের পেছনে প্রাচীরের চারপাশে জড়িয়ে আছে সূরা বাককারতের ২৫৫ তম আয়াত এবং “আয়াতুল কর্সী”। আয়া সোফিয়া অটোমান আমলে বিভিন্ন সময়ে মিনার, মাদ্রাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেডিকেল স্কুল, মুকাককিথনে, ফোয়ারা এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সাহায্যে একটি সুন্দর কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছিল।
সুলতান আবদুল মেজিদের শাসনামলেও ভেতরগত বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তারমধ্যে উল্লেখ যোগ্য ৮টি ক্যালিগ্রাফি প্লেটগুলি প্রধান ঘরের দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে।
“মহান আল্লাহ তায়ালা, নবী মুহাম্মদ (স.), হযরত আবু বকর (র.), হযরত ওমর (র.), হযরত ওসমান (র.), হযরত আলী (র.), হযরত হাসান (র.) ও হোসাইন (র.)” নামে ক্যালিগ্রাফিগুলো ইসলামী বিশ্বের বৃহত্তম ক্যালিগ্রাফি প্লেট হিসাবে পরিচিত। একই ক্যালিগ্রাফর গম্বুজটির মাঝখানে সুরা আন নুরের ৩৫ তম আয়াত লিখেছিলেন।
বিল্ডিংয়ে অটোমান সংযোজনগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হ’ল ১৭৩৯ সালে সুলতান মাহমুদ প্রথম নির্মিত লাইব্রেরি। পাঠাগারটিতে রিডিং হল, ট্রেজারি-ই কুতুব (বই যেখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে) এবং এই দুটি বিভাগের মধ্যে করিডোর রয়েছে। (১৯৬৯ সালে লাইব্রেরির প্রায় ৫,০০০ পাণ্ডুলিপি সোলেইমানিয়া লাইব্রেরিতে স্থানান্তরিত হয়।) ইমরাট হাউসটি আয়া সোফিয়ার উত্তর-পূর্বে দরিদ্র ও ধনী লোকদের খাবার সরবরাহের জন্য সুলতান প্রথম মাহমুদ দ্বারা ১৭৪৩ সালে নির্মিত একটি দাতব্য সংস্থা ছিল। এটি ছিল একটি অনাথাশ্রম।
সুলতান আবদুল মেজিদের মোজাইক তুঘরা, ১৮৪৭ এবং ১৮৪৯ এর মধ্যে ইতালীয় মাস্টার এন ল্যাঞ্জনি দ্বারা তৈরি করেছিলেন। যা ফোসাতী সুলতান আবদুল মেজিদেরকে উপহার দিয়েছিল; এটি গোলাকার আকৃতির, সোনার গ্লাইডযুক্ত মোজাইক দানা (টেসেরা) নিয়ে মাটিতে সবুজ রঙের মোজাইক দিয়ে সূচিকর্মিত। তখন কার সময়ে মোজাইক তুঘরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সময়ের পরিক্রমায় এমন অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে আয়া সোফিয়া ব্যবহৃত হতে থাকে মুসলিমদের প্রার্থনালয় মসজিদ হিসেবে। সে সময় এ স্থাপনাটিকে ‘ইম্পেরিয়াল মসজিদ’ নামে ঘোষণা দিয়ে প্রধান মসজিদের মর্যাদা দেয়া হয়। ৪৮১ বছর মুসলমানরা এ মসজিদে নামাজ পড়েছেন।
সমাধি
দ্বিতীয় সেলিমের সমাধি আয়া সোফিয়ার সুলতানের প্রথম সমাধিতে পরিণত হয়েছিল। সুলতান, পত্নী এবং প্রিন্সেস সহ আয়া সোফিয়ায় বিভিন্ন ৪৩ টি সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে সুলতান তৃতীয় মুরাদ, সুলতান তৃতীয় মেহমেত, সাফিয়ে সুলতান এবং নুরবানু সুলতান রয়েছেন।
সুলতানদের সমাধিতে টাইলস, সুলতান দ্বিতীয় সেলিম সমাধির অভ্যন্তরটি ১৬তম শতাব্দীর সবচেয়ে সুন্দর টাইলস দিয়ে সজ্জিত। নীচের জানালাগুলির উপরের অংশে, সমাধিসৌধের চারপাশের টাইল বেল্টে, সাদা সেলি-সুলাস স্টাইলযুক্ত নীল পটভূমিতে “সুরা আল-বাকারা” এবং “আয়াতুল্লাহ কুরসী” লেখা আছে।
মসজিদ থেকে জাদুঘর
যদিও এটি ১৯২৩ সালে প্রজাতন্ত্রের ঘোষণার পরে মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে আয়া সোফিয়া ১৯৩১ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩১ সালে আমেরিকা বাইজেন্টাইন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক থমাস হুইটমোর, আয়া সোফিয়ার মোজাইকগুলির পুনর্বাসনের জন্য তুরস্কে নতুন সরকারের অনুমতি চেয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে অনুমতির পরে শুরু হওয়া এই কাজগুলিতে ১৫ বছর সময় লেগেছিল এবং ১৯৪৭ সালে এটি সমাপ্ত হয়েছিল।
কাজ শুরুর কিছু সময় পরে ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আয়া সোফিয়াকে একটি যাদুঘর হিসাবে পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাদুঘরটি ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫ এ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল।
মসজিদে রূপান্তরের পর এর দেয়ালে মার্বেল পাথরে অঙ্কিত যীশু খ্রিস্টের অনেক গুলো ছবি সিমেন্ট দিয়ে মুছে দেওয়া হয়। ছবিগুলো প্রায় ৫০০ বছরের জন্য সিমেন্টের নিচে চাপা পড়ে। কিন্তু এই স্থাপনাটিকে যাদুঘরে রূপান্তরের পর ছবিগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়। ফলে যীশুখ্রিস্টের ছবিগুলো অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে অঙ্কিত “আল্লাহু ও মুহাম্মদ” এর আরবিতে অঙ্কিত মার্বেল পাথরও এর পাশাপাশি সংরক্ষিত হয়। তাই এই নামগুলোর পাথর অনেক বেশি উজ্জ্বল থাকে। তবে খুব সতর্কতার সাথে এটা করা হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ইসলামিক যে নিদর্শনগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷
বিভিন্ন বিভাগে সময়ে সময়ে শুরু হওয়া পুনরুদ্ধার কাজগুলি আজও অব্যাহত রয়েছে। এরপর থেকে এই স্থাপনায় নতুন নিয়ম প্রবর্তন হয়। প্রধান নিয়মটি হল। “এই স্থাপনার মূল অংশ বা হলরুম ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ, সেটি মুসলিম অথবা খ্রিস্টান ধর্ম উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই স্থাপনার উভয় ধর্মের জন্য আলাদা সংরক্ষিত জায়গা রয়েছে। অর্থাৎ এই কমপ্লেক্ষটিতে একটি মসজিদ ও একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। যা শুধুমাত্র যাদুঘরের কর্মচারী কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত।”
আয়া সোফিয়া নিয়ে ২০০০ এর দশকের কিছু আলোচনা …
১৯৬৭ সালের ২৫ জুলাই ইস্তাম্বুল সফরে থাকা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের নেতা পোপ পল ৬ আয়া সোফিয়ায় গিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন। তারপরে একদিন পরে জাতীয় তুর্কি ছাত্র সংঘের আধিকারিকরাও সাড়া দিয়ে আয়া সোফিয়া যাদুঘরে নামাজ আদায় করল। এই উপলক্ষে, আয়া সোফিয়ার স্থিতি নিয়ে প্রথম গুরুতর বিতর্ক হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের সর্বশেষ পোপের সফরের বহু বছর পরে, ২০১৪ সালের নভেম্বরে, পোপ ফ্রান্সিস ইস্তাম্বুল সফরকালে আয়া সোফিয়া সফর করেছিলেন এবং পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পর্কে যাদুঘর পরিচালকের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছিলেন।
প্রায় ২৫ বছর পরে, ১৯৯১ সালে, হানকার প্যাভিলিয়ন (সুলতানদের বিশ্রামের জন্য এবং মাহমুতের রাজত্বকালে আয়া সোফিয়ার মূল ভবনের বাইরে অজু করার জন্য নির্মিত জায়গাটি) উপাসনার জন্য খোলা হয়েছিল। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এখানে একজন ইমামও নিয়োগ করা হয়েছিল। হানকার প্যাভিলিয়নে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেওয়া হয়, জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা হয় এবং ঈদের নামাজও আদায় করা হয়। ২০০৬ সালে খ্রিস্টান ও মুসলিম যাদুঘরের কর্মীদের জন্য একটি প্রার্থনার রুম খোলা হয়েছিল। ২০১৩ সালে, ইস্তাম্বুল বিজয়ের ৫৬০ তম বার্ষিকীতে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বলেন, ” সুলতান আহমেত মসজিদ খুব ফাঁকা। সুলতান আহমেত যদি পূরণ করেন তবে আমরা আয়া সোফিয়াকেও এজেন্ডায় নিতে পারি।”
২১ জুন, ২০১৭, ধর্ম বিষয়ক প্রধান আয়া সোফিয়ায় রামাজানে কদর নাইট প্রোগ্রামের আয়োজন করেছিলেন। শেষ অবধি, মার্চ ২০১৮ সালে আয়া সোফিয়া জাদুঘরে ইয়েদিতেপে বিয়েনালী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়িপ এরদোগানের বক্তব্যের আগে কোরআন পাঠ করা হয়েছিল।
ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মের সহাবস্থান
আয়া সোফিয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো যেন এর মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে৷ একপাশে মোহাম্মদ, অন্যদিকে আল্লাহ লেখা আবার মাদার মেরীর কোলে যীশু খ্রিষ্ট সবই আছে এখানে৷ সেই সাথে গম্বুজে ৪০টি জানালা দিয়ে আলো এসে এটিকে যেন অতিপ্রাকৃত করে তোলে৷বর্তমানে খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের ধর্মের নানা প্রতীক এবং বাণী পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় আয়া সোফিয়াতে। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধর্মবিশ্বাসের আশ্চর্য এক সহাবস্থান চোখে পড়ে জাদুঘরটিতে।
ইউনেস্কো
১৯৮৫ সালে আয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷
ভ্রমণ
এই জাদুঘর রবিবার-বৃহস্পতিবার সকাল ৯.৩০ থেকে বিকাল ৪.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। এর প্রবেশ মূল্য ১০০ তুর্কি লিরা (প্রায় ৳১,৩০০)। এটি তুরস্কের সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণশীল স্থান।
বর্তমানের আয়া সোফিয়া, দ্বিতীয় মেয়াদে কি আবার মসজিদে রূপান্তরিত হতে চলেছে …
বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর পুরনো মসজিদ আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদ করার দাবিকে এগিয়ে আসেন। ২০১৪ সালে আনাতোলিয়ান ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘জায়নামাজ নিয়ে আয়া সুফিয়ায় চলো।’
এরদোগানের সরকার আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের প্রাথমিক দাপ হিসাবে ৮৫ বছর পর আয়া সোফিয়ায় আজান ও নামাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আয়া সোফিয়ায় গত ৮৫ বছরের মধ্যে ২০১৫ সালেই প্রথমবারের মতো একজন আলেম কোরআন পাঠ করেন। এর পর থেকে তুরস্কের সরকার প্রতিবছর রমজানে বা ইস্তাবুল বিজয়ের দিন সেখানে কোরআন পাঠ করে আসছে।
৩১ মার্চ ২০১৯ অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, আয়া সোফিয়াকে আইনিভাবে মসজিদে রূপান্তর করা হবে। ১০ই মে ২০২০ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের যোগাযোগ পরিচালক ফাহের্তিন আল্টুন তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আয়া সোফিয়া ক্যাথেড্রাল আবারও একটি মুসলিম মসজিদে রূপান্তরিত হবে। আয়া সোফিয়ার একটি ছবি সহ টুইট করে বলেছেন, “আমরা এটি মিস করেছি! তবে আরও কিছুটা ধৈর্য্য। আমরা একসাথে সফল হবো …” ২৮ই মে ২০২০ বৃহস্পতিবার রাতে একটি টেলিভিশন সম্প্রচারকালে এরদোগান বলেছিলেন, “বিজয় উত্সবের অংশ হিসাবে (আগামী কাল ২৯ই মে ইস্তাবুল বিজয়ের ৫৬৭তম বার্ষিকীর দিন) আল- সূরা ফাতহ্ (বিজয়) পাঠ করা হবে এবং আয়া সোফিয়ায় প্রার্থনা করা হবে।”
ফাতিহ সুলতান মেহমেত ইস্তাম্বুলে বিজয় অর্জনের ৫৬৭তম বছর ২৯ই মে ২০২০ শুক্রবার ইস্তাম্বুলের বিজয় উদযাপিত হয়েছিল, আয়া সোফিয়ায় একটি বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে। সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রনালয় তুর্কি রাষ্ট্রপতির যোগাযোগ অধিদপ্তরের যোগাযোগের সাথে সমন্বিতভাবে “আয়া সোফিয়ায় বিজয় উৎসব” এর আয়োজন করে। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়িপ এরদোগান ভিডিওর মাধ্যমে আয়া সোফিয়াতে কুরআনের ৪৮ তম সূরা আল-ফাতহ তেলাওয়াত করা প্রোগ্রামটিতে অংশ গ্রহন করেন । ইমামের তেলাওয়াত ও দোয়ার পর এরদোগান উক্ত তেলাওয়াতের অর্থ পাঠ করেন। তারপর ইস্তান্বুল বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনা ও আয়া সোফিয়া সর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।
পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত হচ্ছে কিনা সময় বলে দিবে…
পরিশেষে
আয়া সুফিয়া পৃথিবীতে স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়। এখানে রোম ও তুর্কি স্থাপত্যশিল্পীরা নিজ নিজ সময়ে কীর্তির সই রেখে পৃথিবীকে অবাক করেছেন। এমন একটি স্থাপত্যকর্ম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। আজও এ স্থাপনাকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের রাজনীতি, বিভেদ এবং আলোচনা-সমালোচনা। তবু সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে, দিনশেষে এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তির শৈল্পিক আবেদনই মূখ্য হয়ে ওঠে দর্শনার্থীদের কাছে। নানা উত্থানপতন এর সাক্ষী হয়ে আয়া সোফিয়া এখনও বিশ্বের মানুষের কাছে সমান আকর্ষণীয়। প্রতিবছর তিন মিলিয়নেরও বেশি দর্শনার্থী তুরস্কের এই কালজয়ী স্থাপনাটি দেখতে ভীড় জমায় ইস্তাম্বুলে। তাদের পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে ইস্তাম্বুল নিজের গল্প বলে যায়।
মু. তারেকুল ইসলাম
পিএইচডি গবেষক, তুরস্ক